জীবনানন্দের হাসি
রবিন জামান খান
“হ্যালো, নাইন নাইন নাইন থেকে বলছি,” খুবই কর্কশ একটা গলা বলে উঠলো। “কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
অপর পক্ষে কোন জবাব নেই, শধু ভারি নিশ্বাসের শব্দ। অপারেটর একটু অধৈর্য হয়ে বললো, “হ্যালো।”
কোন জবাব নেই। “আপনার জরুরি প্রয়োজনটা বলুন, না হলে আমরা সাহায্য করবো কিভাবে? হ্যালো।”
ভারি নিঃশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হলো। “হ্যালো, হ্যালো, মাঝবয়সি একজন মানুষের আতঙ্কিত গলা। “আমাকে আমাকে খুন করে ফেলতে চাইছে একজন…
***
“স্যার, জীবনানন্দ দাসকে যখন ট্রামের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়, তখন উনি নাকি হাসছিলেন?” ডক্টর আবরার মাসুদের সামনে বসা মানুষটা খানিকটা উদাস গলায় বলে উঠলো। ডাক্তার মাসুদের পরিপাটি ইনটেরিওর অফিসের জানালার স্কাই গ্লাস ভেদ করে তার দৃষ্টি চলে গেছে ঢাকা শহরের গাঢ় নীল আকাশের দিকে।
ডাক্তার মাসুদ কিছুটা নিরাসক্ত আর খানিকটা অবাক ভঙ্গিতে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকালো লোকটার দিকে। মানুষটার কথা সে পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। “সরি?
“স্যার, বলছিলাম আহত রক্তাক্ত জীবনানন্দ দাসকে যখন ট্রামের ক্যাচারের ভেতর থেকে টেনে বের করা হয় উনার মুখে নাকি ঝুলে ছিলো অদ্ভুত এক টুকরো হাসি,” মানুষটার নিরাসক্ত দৃষ্টি এখনো চষে বেড়াচ্ছে ঢাকা শহরের নীলাকাশে। ডাক্তার মাসুদ যতোটা বিরক্ত হয়েছিলো তারচেয়ে অধিক বিরক্তির সাথে একবার ঘড়ি দেখলো। লাঞ্চের বেশি বাকি নেই। ইতিমধ্যেই সে তার সেক্রেটারি মারিয়াকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে আজকের মতো। কারণ তার নাকি কী জরুরি কাজ পড়ে গেছে। আর সে নিজে ফেঁসে গেছে এই অদ্ভুত মানুষটার সাথে। নিজের দামি আইফোনটার ওয়াইফাই অফ করে টেবিলের ওপরে রেখে দিলো সে। এই লোকটার সাথে তার সেশন শেষ করতে হবে। বিরক্তিরকর মানষটাকে সে আর দেখতে চায় না। ফোন রেখে মানুষটাকে আরেকবার ভালোভাবে অবলোকন করলো সাইকোলজিস্ট আবরার মাসুদ।
মানুষটার পরনে টুটাফুটা নীল জিন্স, ময়লা হলুদ একটা সোয়েটার, সেটার কয়েক জায়গায় রঙ চটে ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে- কয়েক জায়গায় আবার ময়লা হয়ে রঙ গাঢ় হলুদ হয়ে গেছে, পেটের কাছে একটা গোলচে কালো পোড়া ফুটোও চোখে পড়লো। মাাথায়-মুখে অবিন্যস্ত চুল-দাড়ি। যে পার্টির মাধ্যমে সে এসেছিলো তারাই তাকে জানিয়েছে লোকটা নাকি একজন ব্যর্থ কবি, ইদানিং তার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডাক্তার মাসুদ ভেবে পেলো না এরকম ফকিরা একটা লোকের তার মতো দামি একজন সাইকোলজিস্টকে দেখানোর সাধ্য হলো কিভাবে। নিশ্চই যে-পার্টির মাধ্যমে তাকে দেখানোর অনুরোধ এসেছে তারাই এর টাকা ম্যানেজ করছে। আর সেও পুরনো পার্টির অনুরোধ ফেলতে না পেরেই এই লোকটার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ধীরে-ধীরে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার অবস্থা হচ্ছে। গত দুই সেশনে লোকটার কোন উন্নতি তো হয়নি বরং আজ মনে হচ্ছে অবস্থা আগের চেয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। সাধারণত একবার পেমেন্টে নিয়ে নিলে যেকোন রোগীর সাথে সে তিনটা সেশন সম্পন্ন করে থাকে। কিন্তু এর সাথে আর কোন অবস্থাতেই সেশন বাড়াবে না। কারো অনুরোধেই নয়। তবে বিদেয় দেয়ার আগে একে একটু ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। এমনিতেই পারিবারিক কারণে তার মেজাজ খারাপ হয়ে ছিলো, তার ওপরে এই লোকটা আবার তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে মন্তব্য করে মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে।
“কি বললেন আপনি? আহত রক্তাক্ত একজন মানুষকে ট্রামের নিচ থেকে টেনে বের করা হলো, আর সে কিনা হাসছিলো?” গলাতে একটু বেশিই চড়া সুর চলে এলেও সেটাকে সামলে নিলো ডক্টর মাসুদ। এসব মানুষকে উত্তেজিত অবস্থায় নয় বরং ঠান্ডা মাথায় ঠিক করতে হয়, আর সে জানেও ব্যাপারটা কিভাবে ঘটাতে হবে। কারণ এটাই তার পেশা।
“কি বললের স্যার!” নীলাকাশ থেকে ঝট করে সে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলো ডক্টর মাসুদের দিকে। “প্রমাণ আছে,” বলে সে বেশ আরাম করে হেলান দিয়ে বসলো চেয়ারটাতে। ছাদের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুলের কড়ে গুনে কি জানি ভাবলো। “চুনিলাল, স্যার। কবি যখন ট্রাম লাইনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন কাছেই একটা মিষ্টির দোকান থেকে চুনিলাল নামে একজন মিষ্টির দোকানদার তাকে চিৎকার করে সাবধান করার চেষ্টা করেছিলো। তরপর উনি ট্রামের নিচে পরার পর সেই লোকটাই প্রথম দৌড়ে এসে তাকে উদ্ধার করে। সেই চুনিলাল লোকটাই বলেছিলো, প্রথম যখন কবিকে টেনে বের করে ট্রেনের ক্যাচারের ভেতর থেকে তার মুখে ঝুলে ছিলো অদ্ভুত এক হাসি,” বলে সে আবারো বাইরে তাকালো, পুরনো সেই বিষন্ন ভাব ফিরে এসেছে তার মুখে। “কি অদ্ভুত না! যে-মানুষটা এই কলকাতার রাস্তা আর ট্রাম নিয়ে কতো সুন্দর কবিতা বলে গেল আর সে কিনা… এই পর্যন্ত বলেই সে ফিসফিসে গলায় আবৃত্তি করতে লাগলো…
‘ফুটপাত থেকে ফুটপাতে…
আদিম সর্পিনী সহোদরার মতো এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে…
“চুনিলাল যে এ-কথাটা লেছে সেটা আপনি কোথায় পেয়েছেন?” ডাক্তার মাসুদ একটু থমকে গেছে লোকটার একেবারে টু দ্য পয়েন্ট বর্নণা শুনে। এই আধ পাগলার কাছে সে এতোটা স্পেসিফিকেশন আশা করেনি।
“শুধু চুনিলাল না তো স্যার, কবির ছাত্র ভূমেন্দ্রর কথা মনে আছে আপনার?” উদাস ভাবের জায়গায় আবারো সেই উত্তেজনা। এবার শুধু দৃষ্টি ফিরে আসাই নয় উত্তেজনার চোটে হাত কচলাতে-কচলাতে সোজা হয়ে বসলো সে। “সেই ভূমেন্দ্র, যার প্রায় সারাটা জীবন কেটেছে কবির জীবন নিয়ে গবেষণা করে। সেও বলেছে, বলে সে ডাক্তার মাসুদের টেবিলের সামনে এসে দুই হাত রেখে উঁবু হে গেল, “আমি নিশ্চিত স্যার, কবি হাসছিলেন।”
ডাক্তার মাসুদ চূড়ান্ত বিরক্তির সাথে আরেকবার ঘড়ি দেখে নিয়ে লোকটার দিকে তাকালো, এর সাথে বরাদ্দ সেশনের সশয় শেষ হতে আর পনেরো মিনিট বাকি। “আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আপনি খোদ সেখানে ছিলেন?” না চাইলেও সে নিজের মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। যদিও সে পেশায় ডাক্তার কিন্তু তার বাবা ছিলো সাহিত্যের শিক্ষক। আর এ-কারণেই তার বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই ছিলো কাব্য চর্চার চল। সে নিজে তার বাপের মতো উদারমনা মানুষ না হয়ে হয়েছে একটা বেনিয়া। কিন্তু পারিবারিক কাব্য চর্চার অভ্যাস আর জীবনানন্দরে প্রতি বাপের অপরিসীম ভালোবাসাটাও সাঞ্চারিত হয়েছে তার মাঝে। আর এই লোক কিনা তার প্রিয় কবি জীবনানন্দকে নিয়ে তাকেই জ্ঞান দিচ্ছে।
ডাক্তার মাসুদের মন্তব্যটা পাত্তাই দিলো না মানুষটা। বরং সে আরো উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, “আমি জানি স্যার,” এই পর্যন্ত বলে সে টেবিলে ছোট করে একটা চাটি মারলো। “আমি জানি, কবি ওরকম একটা মুমূর্ষ মুহূর্তে কেন হাসছিলেন,” বলে সে নিজেও বেশ খানিকটা পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বসার রকিং চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে দুলতে লাগলো। “ওটা আসলে কবির হাসি ছিলো না। পৃথিবীর প্রতি তার জমানো রাগ-অভিমান-ভালোবাসা আর শঙ্কার বহিঃপ্রকাশও ছিলো না। ওটা ছিলো, ওটা ছিলো…
‘… চরণে জরায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল…
লক্ষকোটি মুমূর্ষের এই কারাগার…
মানুষটাকে অবলোকন করতে-করতে ডাক্তার মাসুদ হঠাৎ একটু ভিন্ন অনুভূতিতে আক্রান্ত হলো। তার মনে হলো অস্থির এই লোকটাকে সুস্থির করতে না পারলে ঝামেলা বাড়বে। মানুষটার অনিয়ন্ত্রিত-অসংলগ্ন কথাবার্তা আর আচরণ তাকে হঠাৎ সামান্য উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। “মিস্টার…” মানুষটাকে ডাকতে গিয়ে সে লোকটার নাম মনে করতে পারলো না। টেবিলে রাখা কাগজ হাতড়াতে লাগলা নামের জন্য। “ইয়ে…” লোকটার ডুকমেন্টগুলো গেল কই?
“বুঝেছেন ডাক্তার,” চেয়ারে দোল খেতে-খেতে মানুষটা বলে চললো। “কবির জীবনটা দুঃসহ এক কারাগারে পরিণত হয়ে গেছিলো। আর এরজন্যে দ্বায়ি কে আমি খুঁজে বের করেছি,” মানুষটা বলে চলেছে ডাক্তার মাসুদ তার প্রোফাইল খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে যাবে তার আগেই চমকে উঠলো। মানুষটাকে একেবারে সরাসরি তার মুখের আধ হাত দূর থেকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। “মিস্টার-”
“এইসবকিছুর জন্যে দ্বায়ি মানুষটাকে আমি খুঁজে বের করেছি,” বলে সে বেশ এক টুকরো আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো আবার।
ডাক্তার মাসুদ একটু স্বস্তি বোধ করলো মানুষটাকে সামান্য শান্ত হতে দেখে। তাকে আরেকটু শান্ত করার জন্যে ডাক্তার বলে উঠলো, “আপনাকে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে, কথাটা বলেই সে নিজের মত পাল্টালো। রিভার্স টেকনিকে কাজ না করে বরং মানুষটাকে আরো একটু খুলতে দেয়া যাক। “তাই নাকি? কী মনে হয় কে দ্বায়ি কবির এই পরিণতির জন্যে? তার স্ত্রী? কিছুটা হালকা স্বরেই বলার চেষ্টা করলো ডাক্তার মাসুদ।
“এইখানেই সবাই ভুলটা করে, লোকটা তার দিকে না তাকিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে দোল খেতে-খেতেই বলে চললো। “কবির স্ত্রী, কবি পেশাগত জীবন, কবির সমসাময়িক মানুষজন এমনকি লোকে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত ছাড়ে না। কিন্তু আসল কারণটাকে সবাই এড়িয়ে যায়,” বলে সে একটু থেমে সোজা ফিরে তাকালো ডাক্তার মাসুদের দিকে। মানুষটার লাল চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি এই প্রথমবারের মতো ডাক্তারকে গভীরভাবে শঙ্কিত করে তুললো। আড়চোখে সে একবার ড্রয়ারের সাথে থাকা ইমার্জেন্সি বাটনটা দেখে নিলো। পর মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেল, সর্বনাশ আজ তার সিকিউরিটির প্রধান ইকবাল অসুস্থতার কারণে আসেনি। তবে এরও বিকল্প ব্যবস্থা আছে। সেটা অবশ্য শেষ ব্যবস্থা, কাজেই নিজেকে সে বোধ দিলো, ধূর এখনো তেমন কিছু হয়নি।
“আসল ব্যাপারটা কি?” মুখে কষ্টের হাসি ফুঁটিয়ে তুলে সে জানতে চাইলো।
“আসল বদমাইশ হলো হারামখোর প্রকাশকেরা,” খুব চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলো যেন সে উচ্চারণ করলো না বরং কামানের মুখ দিয়ে যেমন আগুনের গোলা বেরিয়ে আসে কথাগুলো যেন ঠিক সেভাবেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো তীব্র ঘৃণায়। অস্থিরতার চোটে বাম হাতার কাছে সোয়েটার কামড়ে ধরলো লোকটা।
“কি?” ডাক্তার শুকনো জিহŸা দিয়ে ঠোঁট চাটলো। আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু কথা বের হলো না।
“বলছি প্রকাশদের কথা, কবির সকল সর্বনাশের পেছনে-তার সব হতাশার পেছনে ছিলো তার হারামখোর প্রকাশকদের হাত। বদমায়েশ প্রকাশকদের কারণেই আমাদের সাহিত্যেরও আজ এই হাল। এই শালারা লেখক কবিদের সব চুষে খেয়ে নিজেরা ফুলে ফেঁপে উঠে আর কবি সাহিত্যিকরা না খেয়ে মরে, মানুষটার কথাগুলোর সাথে লেগে থাকা তীব্র ঘৃণা যেন শুধুই শব্দ নয় বরং কঠিন কোন বস্তু, চাইলেই ধরা যাবে, কিংবা কারো গায়ে লাগলে গা পুড়ে যাবে। গলায় থাকা তীব্র ঘৃণার দাপটে শিউরে উঠলো ডাক্তার।
‘অদ্ভুত এক আঁধার এক এসেছে আজ পৃথিবীতে-
“কবি যে আধঁরের কথা বলে গেছেন তার কবিতায় এই আঁধার আসলে পৃথিবীর আলো-আঁধার নয়, নিজের অসংলগ্ন আবৃত্তি থামিয়ে সে যোগ করলো, “এই আঁধার বরং আমাদের সাহিত্যের ঘোরতর কালো অন্ধকার। আর এই অন্ধকারের পেছনে একমাত্র দ্বায়ি বাংলার প্রকাশনা ব্যবস্থা, সে একটা আঙ্গুল তুলে রাজনৈতিক নেতাদের মতো সে বলে চলেছে। “এই জঘন্য প্রকাশনা ব্যবস্থার কারণেই কবি আত্মহত্যা করেছে ট্রামের নিচে পড়ে। ভাবতে পারেন? ডাক্তার মানুষের দিকে তাকিয়ে সে উন্মাদের মতো বলে উঠলো, “একটা মানুষ ট্রামের ক্যাচারের সাথে আটকে আহত হয়ে মরে গেল। কিছু লোভি মানুষের কারণেই,” শেষ কথাটা বলার সময় প্রায় চিৎকার করে উঠলো সে।
“আপনার কি মনে হয়না আপনি একটু বেশিই কল্পনা-
“এদের কারণেই শেষ বয়সে না-খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে মানিক বাবু, এদের কারণেই কতো লেখক কবি ধ্বংস হয়ে গেছে- এমনকি আমার মতো-
“প্রকাশনা একটা ব্যবসা, এটা আপনাকে বুঝতে হবে। কারো বই না বিক্রি হলে-
“কখনোই না। রক্তচোষারা কখনো ব্যবসা করে না। এরা মানুষের রক্ত চুষে খেয়ে জোঁকের মতো ফুলে ওঠে, বলে সে ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল। ডাক্তার মাসুদ তার ডেস্কের প্রথম ড্রয়ারটা আলগা করে ফেললো। এভাবে নিজের চেম্বারের ভেতরে সামান্য অবহেলার কারণে বোকার মতো ঝামেলায় পড়তে হবে, কে জানতো! সে এতেটা দ্রæত মানুষটার কাছ থেকে এরকম ভয়ঙ্কর রিঅ্যাকশন আশা করেনি। ভেবেছিলো সহজেই সামলাতে পারবে। কিন্তু…
“এরা জোঁক, এরা হারামখোর,” বলে সে সোয়েটারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেসে উঠলো। “আপনি জানেন আমাকে কিভাবে চুষে খেয়েছে এরা। আমার কবিতার বই… তীব্র ঘৃণায় মুখ বাঁকা হয়ে গেল তার। “নিজেকে আমার কী মনে হয় জানেন? জবিনানন্দ দাসের আট বছর আগে একদিন’ কবিতার সেই লাশের মতো, যে কিনা কোনদিন আর জাগবে না।
’… লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে টেবিলের পরে…
চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক উঁচু গলায় বলে চলেছে সে।
‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় অন্ধকার…
এইটুক বলেই সে উন্মাদের মতো হেসে উঠে খুব শান্ত গলায় যোগ করলো, “কিন্তু আমাকে তো জাগতে হতোই তাই আমার প্রকাশককে শেষ করে এসেছি এখানে আসার আগে, তার গলা একেবারেই শান্ত। যেন বিকেলের চা চক্রে কারো নামে তল্পি করছে, এমন সুরে বলে উঠলো সে কথাটা। “এই যে দেখেন এটা দিয়ে,” ডাক্তার মাসুদ টের পেল মানুষটার সোয়েটারে ভেতরে শক্ত কিছু একটা নড়াচড়া করছে। কুল-কুল ঘাম শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেল তার। ড্রয়ারে রাখা পিস্তলের বাটে শক্ত হলো ডাক্তারের আঙ্গুল।
লোকটা সোয়েটারের ভেতরে জিনিসটা নড়াচড়া করতে করতে আনমনে মাথা নেড়ে সেই একই শান্ত সুরে যোগ করলো, “প্রকাশক তো গেছে এবার –
মানুষটা কথা শেষ করার আগেই ডাক্তার মাসুদ ড্রয়ার থেকে টান দিয়ে পিস্তলটা বের করে এনে তাক করলো লোকটার দিকে। সাথে-সাথে মানুষটা এক ধাক্কায় উল্টে দিলো টেবিলটা। ট্রিগারে চাপ লেগে গুলি ছুটে গেল ছাদের দিকে আর টেবিলের শক্ত ধাক্কায় মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারালো ডাক্তার মাসুদ।
আর হলুদ সোয়েটার পরা কবি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ফোনের দিকে।
কয়েক দিন পর…
নাটকীয়তা শব্দটা শোনেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কিন্তু সত্যিকারের নাটকীয়তা বাস্তব জীবনে ঘটতে দেখেছে- বিশেষ করে নিজের জীবনে এমন মানুষের সংখ্যা সম্ভবত একেবারেই হাতে গোনা। কোন একদিন নিজেকে সেই হাতে গোনা কয়েকজনের ভেতরে আবিষ্কার করবে ডাক্তার আবরার মাসুদ এমনটা কোনদিন ভাবতেও পারেনি। ছোটবেলা থেকেই সে মেধাবী,স্বার্থপর এবং খানিকটা হিংস্র প্রকৃতির। আর এই তিনটে গুনের সমম্বয়ে সে নিজেকে করে তুলেছিলো তুলনাহীন। নিজেকে সে সবসময় ভাবতো একজন আলফা মেল, আর তাকে কিনা বোকার মতো ফাঁদে পড়তে হলো এইজন অর্ধ পাগল মানুষের কাছে।
বিশেষ প্রিজন সেলের নোংরা বিছানার গন্ধ ওঠা চাদরে শুয়ে ব্যাপারটা ভাবতেই তার মাথা আবারো গরম হয়ে উঠলো। বিগত কয়েকদিন ধরে এই নোংরা সেলটাই তার ঠিকানা। যে-পর্যন্ত কোর্ট থেকে মামলার নির্দিষ্ট কোন ফলাফল না হয়, কিংবা সে জামিন না পায় এখানেই থাকতে হবে তাকে। কিন্তু ব্যাপারটা এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে তার। সেদিন চেম্বারে ঘটে যাওয়া ব্যাপাগুলো এখনো ঝাপসা মনে হয়। কী ঘটেছিলো সেদিন সেটা যেমন পরিষ্কার নয় তারচেয়ে বেশি ঘোলাটে লাগে পরের ঘটনাগুলো।
সেদিন চেম্বারে সেই পাগল কবির মুখোমুখি হবার পর যখন তার জ্ঞান ফিরলো নিজেকে সে আবিষ্কার করে চেম্বারের কটে। চারপাশে অনেক লোকজন আর পুলিশ। পুলিশ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে তার আগেই সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করে পুলিশ তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে, আর পুলিশের মাঝে জড়োসরো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই কবি। পরবর্তীতে জানতে পেরেছে সে জ্ঞান হারানোর পর সেই কবিই নাকি ইমার্জেন্সিতে কল করে পুলিশ ডেকে এনেছে। তারপর পুলিশকে বলেছে ডাক্তার আবরার মাসুদ নাকি তাকে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। আর সে কোনমতে ডাক্তারের দিকে টেবিল ঠেলে দিয়ে রক্ষা করেছে নিজেকে। ডাক্তার মাসুদ প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায় পুলিশের কথা শুনে, এরপর প্রথমে শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা কওে, আসলে কী ঘটেছিলো। কিন্তু পুলিশ তার চেম্বারের সিসি টিভির ফুটেজ চেক করার সাথে-সাথে তাকে গ্রেপ্তার করে। কারণ ওটাতে পরিষ্কার দেখা যায় ডাক্তারই আগে লোকটার দিকে পিস্তল তাক করে, তারপর লোকটা টেবিল ঠেলে দেয়।
গ্রেপ্তারের পর সবকিছুই ঘটতে থাকে খুব দ্রæত। তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে মামল কোর্টে ওঠে। তাকে নিয়ে মেতে ওঠে ইলেকট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়া। নিরীহ রোগীর পক্ষ নিয়ে সবাই তাকে ভিলেন বানিয়ে ছেড়ে দেয়। সিসিটিভির ফুটেজ হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় কাল। কারণ সিসি টিভির ফুটেজে লোকটার কথারই প্রমাণ পাওয়া যায় পরিষ্কার। ডাক্তার মাসুদ সবাইকে যতো বোঝানোর চেষ্টটা করে কোন কাজ হয়না কারণ সিসি টিভিতে তো আর সাউন্ড রেকর্ড হয়নি, রেকর্ড হয়েছে শুধু দৃশ্য। আার সেটাতে দেখা যাচ্ছে… এখনো ভাবতেই ডাক্তার মাসুদের মাথা গরম হয়ে ওঠে।
কিভাবে একজন সাধারণ অর্ধ পাগল এভাবে তাকে ঘোল খাইয়ে দিলো। পরবর্তী ঘটনার প্রেক্ষিতে এটা পরিষ্কার যে লোকটা সেদিন যা-যা করেছে সবই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে কিন্তু কেন সে এরকম করবে, এটাই বুঝতে পারে না ডাক্তার মাসুদ… কেন?
টং টং শব্দের সাথে একটু চমকে উঠলো সে। শোয়া থেকে আধশোয়া হয়ে বসলো সে। পুলিশের একজন হাবিলদার হাতের লাঠি দিয়ে সেলের লোহার শিকের গায়ে বাড়ি দিয়েছে। “এই বেটা ডাক্তর, তোমার সাথে দেহা করার জন্যে একজন মহিলা আসছে…
ডাক্তার মাসুদ একটু সোজা হয়ে বসলো। মহিলা কে আসতে পারে, এই সময়ে। তার নিয়োগ দেয়া উকিলই একজন মহিলা কিন্তু তার সাথে তো মিটিং হবার কথা তো কাল সকালে। তাকে সেলের দরজা খুলে ভিজিটসরস রুমে নিয়ে আসা হলো।
কিন্তু সেখানে যাকে বসে থাকতে দেখলো, তাকে দেখে খুশি যতোটা হলো তারচেয়ে অবাক হলো সে অনেক বেশি। তার হবু ডিভোর্সি স্ত্রী কবিতা বসে আছে।
আর যাকেই হোক কবিতাকে এখানে আশা করেনি সে। যে মানুষটা এই ঘটনার আগেই তাকে ছেড়ে গেছিলো তাকে, যাবার সময় বলে গেছিলো যাবার সমসয়ে উকিল নোটিশ পাঠাবে সে মানুষটা আর যাই হোক এরকম সময় তাকে দেখতে জেলখানায় আসার কোন কারণ নেই।
“কি ব্যাপার তুমি, এখানে,” যদিও এসব জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলারই সুযোগ থাকে না কিন্তু তাদের জন্যে চেয়ার টেবিল আছে। টাকার দাপট সবখানেই আছে। ডাক্তার মাসুদের উকিল তার জন্যে এই ব্যবস্থাগুলো করেছে।
ডাক্তারের কথার জবাবে কবিতা কিছু বললো না। মৃদু হাসলো শুধু, মাথার সিল্কি চুলগুলা দুলিয়ে বলে উটলো, “আশা করোনি মনে হয়?
“করার কোন কারণ আছে কি?” ডাক্তারের খুবই বিরক্ত লাগছে। সে জানে কবিতা এখানে তার জন্যে সহানুভূতি দেখাতে আসেনি বরং তার দুরবস্থা দেখে আনন্দ নিতে এসেছে। “দেখো, তুমি যদি উল্টোপাল্টা কিছু বলতে চাও আমি তোমার কথা শুনতে আগ্রহী নই। আর তোমার নোটিশের জবাব আমি ঠিক সময়মতো দিয়ে দিবো। বলে ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরতেই কবিতা বলে উঠলো, “ভুল ডাক্তার সাহেব, জানতে চাওনা তুমি এখানে কেন?
ডাক্তার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো যাবার জন্যে কিন্তু কবিতার শেষ কথাগুলো কানে যেতেই একটা শিহরণ খেলে গেল তার শরীরে। মুহূর্তের ভেতরে ঝট করে ফিরে তাকালো সে তার প্রায় প্রক্তন স্ত্রীর দিকে। “মানে?
“আগে বসো শান্ত হয়ে, সেন্ট্রিদের টাকা দেয়া আছে। ওরা সময় অ্যালাও করবে, কবিতা এক পায়ের ওপরে আরেক পা চাপিয়ে দিলো। “তুমি তো নিজেকে খুব বুদ্ধিমান আর ক্ষমতাশালী মনে করো। আর তোমার এই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ছিলো আমারই বান্ধবীর সাতে তোমার প্রেম করা। একবারও ভেবে দেখেছিলে ব্যাপারটা আমাকে কতোটা কষ্ট দিতে পারে?” কবিতার চোখে রাগ-ঘৃণা আর উদাসীনতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
“ওসব নিয়ে তো আমরা একটা সমোঝতায়-
“কোনদিনই না মাসুদ। তুমি,” বলে সে একটা আঙ্গুল তুললো তার দিকে। “তোমার মতো মানুষেরা কোনদিনই শোধরায় না। আমি তোমাকে যতোই উকিল নোটিশ পাঠাই কিংবা তোমার কাছ থেকে টাকা আদায় করি, আমি জানতাম ওগুলোর কোনটাই তোমার জন্যে ব্যাপার না। আর এ-কারণেই আমি তোমার সবচেয়ে আহংকারের জায়গাতে আঘাত করতে চেয়েছিলাম। আর তোমার সবচেয়ে বড় অহংকারের জায়গা হলো তোমার বুদ্ধি আর তোমার ইমেজ।”
ডাক্তার মাসুদের ভ্রæ কুঁচকে উঠলো। “মানে?
“মানে ওই কবি, আসলে আমারই নিয়ো দেয়া লোক ছিলো। বিশেষ ক্লায়েন্ট থেকে তাকে দেখার জন্যে অনুরোধ, সেদিন তোমার চিফ সিকিউরিটি অসুস্থ থাকা, তোমার সেক্রেটারির আগে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সবই সাজানো হয়েছিলো তোমাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে।”
“অসম্ভব,” ডাক্তার মাসুদ রাগে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো। মনের গহীন কোনে সে জানতো উল্টোপাল্টা কিছু একটা ঘটেছে কিন্তু এইভাবে সবাই তাকে…“অসম্ভব, আবারো বলে উঠলো সে।
“মোটেই নয়, মাসুদ। শুরু থেকে খেয়াল করে দেখো লোকটার প্রথম দুই দিনের সেশন, তারপর তৃতীয় দিনে প্রথম থেকে উল্টোপাল্টা কথা বলা, সবই সাজানো হয়েছিলো আসলে তোমাকে নিয়ে খেলার জন্য। বিশেষ করে সে জানতো কবি জীবনানন্দকে নিয়ে খোঁচালে তুমি উত্তেজিত হয়ে উঠবে। অবশ্য তাকে এই তথ্যটা আমিই দিয়েছিলাম। তারপর প্রকাশককে মেরে রেখে এসেছে পিস্তল দিয়ে এসবই ছিলো তোমাকে ভয় দেখানো ও উত্তেজিত করার প্রচেষ্টা, যাতে তুমি একটা ভুল করো আর সে সেটার সুযোগ নিতে পারে। আর তুমি তাই করেছো। আসলে লোকটার কাছে কিছুই ছিলো না, পিস্তল তো দূরে থাক, বল সে মৃদু হেসে উঠলো।
“অসম্ভভ,” ডাক্তারের মাথার তার কেঁটে গেছে। একই কথা বার-বার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে সে। একজন সাধারণ লোক তাকে নিয়ে এভাবে খেলে গেল মেনেই নিতে পারছে না সে। “কিন্তু এতে তার স্বার্থ কি?
“স্বার্থটা তার নয় আমার। আর তার স্বার্থ হলো সে একজন ভাড়াটে লোক। নিজেকে সে বলে থাকে অশরীরী,” বলে হেসে উঠলো কবিতা। “যে নাকি অশরীরীর মতোই যে-কাউকে ঘাবড়ে দিতে পারে। যাকগে, অমি যা চেয়েছি তা হয়েছে কাজেই-
“কিছুই হয়নি, কবিতা,” ডাক্তার শান্তভাবে বলে উঠলো। “তুমি কি মনে করো নিজেকে এবাবে সব সাজিয়ে আমাকে শাস্তি দিতে পারবে। যাও পারতে আমাকে এখনই এসব বলে বিরাট ভুল করলে। আমি ঠিকই এই জাল কেটে বেরিয়ে-
“আমি জানি সেটা মাসুদ,” বলে কবিতা হেসে উঠলো। “আর আমার উদ্দেশ্যও সেটাই। আমার প্রথম উদ্দেশ্য ছিলো তোমার বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করা। সেটা আমি করেছি। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো তোমার ইমেজ নষ্ট করা। তুমি যতোই আইন আদালতের জাল কেটে বেরিয়ে যাও তোমার ইমেজ অনেকটাই গেছে। আর বাকিটাও যাতে যায় আমি দেখবো,” বলে কবিতা উঠে দাঁড়ালো। “আপাতত বিদায়, বলে সে চলে যাচ্ছিলো পেছন থেকে ডাক্তার বলে উঠলো, “পারবে না, কবিতা। অকারণেই এসব করছো।”
যেতে যেতে কবিতা ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে বলে উঠলো, “আমি পারবো মাসুদ। কারণ আমার কাছে একজন অশরীরী আছে,” বলে সে আরেকটু জোরে হেসে উঠে যোগ করলো, “আর প্রতিকী অর্থে তার কাছে আছে জীবনানন্দের হাসি আছে, বলে সে হাসতে-হাসতে চলে গেল।
পেছনে স্থানুর মতো বসে রইলো ডাক্তার মাসুদ। অশরীরী নামক লোকটা কিভাবে জীবনানন্দ দাসের হাসির কথা বলে তাকে বোকা বানিয়েছে ভেবে আরক দফা রাগের হলকা বয়ে গেল তার শরীরে।