শেষ ঠগী

শেষ ঠগী

রবিন জামান খান

সত্যিকার অর্থে একেই সম্ভবত বলে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসা।

তীব্র বৃষ্টির চোটে মনে হচ্ছে যেন শুধু পানি না, যেকোন সময়ে আকাশটাই যেন মাথার ওপরে নেমে আসবে। যদিও বৃষ্টির কারণে সামনের দৃশ্য সামান্য ঘোলাটে দেখাচ্ছে কিন্তু সত্যি কথা হলো স্লীম্যান  সবই দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার। আর সে-কারণেই সে ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত দোদুল্যমান অনুভূতিতে ভুগছে। কিন্তু নিজেই ঠিক পরিষ্কার হতে পারছে না এই অনুভূতির প্রকৃত কারণটা আসলে কি। অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খানিকটা অস্থির হয়ে ওঠা ঘোড়াটাকে সামলে নিয়ে নিজের দৃষ্টি স্থির করার চেষ্টা করলো সে মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষটার দিকে।

একজন মানুষের মনোস্তত্তে¡র গহীনে আসলে কী চলছে সেটা বোঝার সবেচেয়ে ভাল উপায় তার চোখের দৃষ্টি অবলোকন করা। নিজের দীর্ঘ আর বিচিত্র কর্মজীবনে বৃটিশ আর্মির অফিসার উইলয়াম হেনরি স্লীম্যান অসংখ্য মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছে। এর ভেতরে দেবতুল্য ভাল মানুষের সংখ্যা যেমন কম নয় ঠিক তেমনি নরকের কীটের চেয়ে নিকৃষ্ট শয়তানের সংখ্যাও কম হবে না। স্লীম্যান মাঝে মাঝে ভাবে বরং দ্বিতীয়টার সংখ্যাই বেশি হবে। আর সে কারণেই সে দমন করার সুযোগ পেয়েছে ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত খুনী দলটাকে।

সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্লীম্যান ফিরে তাকালো ঠিক তার পাশে। বিরাটাকায় একটা কালো মাদী ঘোড়ায় উপবিষ্ট ততোধিক বিরাটাকায় মানুষটা ভারতীয় হলেও সে ই সম্ভবত এখানে সর্বাধিক উচ্চতা আর সবচেয়ে চওড়া কাঁধের অধিকারী। আক্ষরিক অর্থেই তার পাশে স্লীম্যানকে লাগছে ছোট বাচ্চাদের মতো। গায়ে সরকারী ইউনিফর্ম পরা থাকলেও মাথায় তার পূর্বপুরুষদের অনুসরণে বিচিত্র কারুকাজ করা ভারী পাগড়ী। মানুষটা এক হাতে ঘোড়া সামলালেও তার অপর হাতে একটা কুঠার। এই কুঠারটা সবসময় নিজের কোমর বন্ধনীতে আটকে রাখলেও এই মুহূর্তে কেন জিনিসটা এক হাতে ধরে রেখেছে মহাবীর সিং এটা স্লীম্যানজানে। সরাসরি বৃটিশ রাজের অধীনে পরিচালিত বিশেষ বাহিনীতে কর্মরত রাজপুত অফিসার মহাবীর সিং হেনরি ¯øীম্যানের দিকে তার হাতের কুঠারটা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাঁকিয়ে সে বুঝিয়ে দিলো একদম প্রস্তুত আছে সে। মহাবীর সিংঙের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হেনরি তার পাশে তাকাতেই প্রথমে দেখতে পের দীর্ঘ নলের লম্বা এক বন্দুক, তার পাশে বন্দুকের দৈর্ঘেও চেয়ে ব্যাস্তানুপাতিক হারে ছোট একজন মানুষ ঘোড়ার ওপরে বসে আছে। বিশেষ এই বাহিনীর অন্যতম সম্পদ বিশিষ্ট্য বন্দুকবাজ জোনাথন ঘোড়ার ওপরে বসে থাকলেও তার হাত জোড়া বুকের ওপরে ভাঁজ করে রাখা। আর তার ঘোড়ার দড়িটা ধরে আছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব চিকন আর লম্বা একজন মানুষ। ¯øীম্যানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোনাথন কোন ভ্রæক্ষেপ না করলেও তার ঘোড়ার দড়ি ধরে রাখা ডুম্বুর অকারণেই সামান্য হেসে উঠলো।

রাজপুত কুস্তিগীর মহাবীর সিং, বন্দুকবাজ জোনাথন আার দলের শক্তিশালী ট্র্যাকার ডুম্বুর, এদেরকে ছাড়িয়ে ¯øীম্যানের দৃষ্টি চলে গেল দলের অন্যপাশে থাকা মানুষটার দিকে। ছয়ি ফিট দুই ইঞ্চি উচ্চতার শক্তিশালী চওড়া কাঁধের রোদে পোড়া চেহারার মানুষটা তীব্র বৃষ্টির ভেতরেও ঘোড়ার ওপরে এমন দীপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে যেন মানুষটার অবয়ব থেকে শক্তি-সাহস আর কর্তব্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বৃটিশ আর্মির বিশেষ দলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জেমন ম্যাকফির দিকে তাকিয়ে স্লীম্যানখুব অবাক হয়ে দেখতে পেল ম্যাকফিও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

মুহূর্তের জন্যে খানিকটা চমকে উঠলেও স্লীম্যান মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গেল, মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষটার দিকে তাকিয়ে যে-দ্বিধা আর দোদুল্যমানতা তার ভেতরে খেলা করে যাচ্ছিলো একই ব্যাপার সম্ভবত অনুভব করতে পেরেছে ক্যাপ্টেন জেমস ম্যাকফিও। কারণ বাঙাল মুল্লুকের মধুপুর অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের কুখ্যাত খুনে দলের যে-দমনক্রীয়া স্লীম্যানশুরু করে আজকে এই পর্যন্ত পৌছাতে পেরেছে সেই অভিযাত্রায় তার সবচেয়ে বিশ^স্ত বন্ধু এবং শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে দিনের পর দিন কাজ করে গেছে তার বন্ধুসম জুনিয়র ম্যাকফি। আর তাই একদিকে সে যেমন ভরসা করে ক্যাপ্টেন ম্যাকফির ওপরে, ঠিক তেমনি নিজের সিনিয়র এবং বড় ভাইসম ¯øীম্যানকে সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারে ক্যাপ্টেন ম্যাকফি। আর ¯øীম্যানের মনের এই ভাবনা যে ভুল নয় সেটা এইমুহূর্তে দুজনের দৃষ্টি বিনিময়ই তার প্রমাণ।

তীব্র বৃষ্টির চাদর ভেদ করে স্লীম্যানআর ম্যাকফি পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো এক মুহূর্ত, তারপর প্রায় চোখে দেখা যায় না এমন সূ²ভাবে ম্যাকফি একবার মাথা নাড়লো স্লীম্যানের দিকে তাকিয়ে, সেইসাথে দ্রæত দুবার নড়ে উঠলো তার চোখের মণিও। সাথে সাথে স্লীম্যানের মনের গহীন কোন থেকে যেন একটা পর্দা সরে গেল। স্লীম্যানের মনে হলো এই তীব্র বৃষ্টির ভেতরেও যেন তার চোখের সামনে তীব্র রোদ হেসে উঠলো। ঘোড়ার দড়িটাকে শক্ত করে ধরে সে সোজা করে ফেললো নিজের গ্রীবা, ম্যাকফির ইশারার জবাবে সেও সামান্য মাধা নেড়ে বুঝিয়ে দিলো ম্যাকফির বক্তব্য বুঝতে পেরেছে সে। ভেতরে ভেতরে নিদারুণ এক শক্তির উত্থান নিয়ে স্লীম্যানফিরে তাকালো সামনের মঞ্চের দিকে। এবার বলতে গেলে প্রায় কোন দ্বিধা ছাড়াই সে সরাসরি তাকালো মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষগুলোর ঠিক মাঝের জনের দিকে। মানুষটার চোখে কোন দ্বিধা নেই, নেই কোন রাগ, ঘৃণা। আসলে কোন উপমা দিয়েই এই মানুষটার দৃষ্টি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ঠিক যেন দৃষ্টির ওপাশটা একটা কৃষ্ণ গহŸর। সেখানে কী আছে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। আর এই কৃষ্ণ গহŸরের দিকে তাকিয়েই বার বার স্লীম্যানদ্বিধান্বিত হয়ে যািচ্ছলো। কিন্তু ম্যাকফির ইশারা পেয়ে সে বুঝতে পেরেছে, যা করতে যাচ্ছে সে সেটাই ঠিক সিদ্ধান্ত।

অদ্ভুত সেই কৃষ্ণ গহŸরের দিকে তাকিয়ে নিজের একটা হাত তুললো উইলিয়াম হেনরি ¯øীম্যান। একহাতে ঘোড়ার দড়ি সামলে ডানহাতটা ওপরে তুললো সে। সাথে সাথে মঞ্চের একপাশে বাদ্য বাজাতে থাকা ঢুলিরা থেমে গেল। সাথে সাথে চারপাশ যেন অনেকটাই শান্ত হয়ে এলো, শুধুমাত্র বজ্রপাত আর বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছিটের সংঘর্ষ যেন বিচিত্র ষড়যন্ত্রের আওয়াজ তুলছে। ¯øীম্যানের ইশারায় বাদ্য থেমে যেতেই, বাদকদের পেছন থেকে সামনে এগিয়ে গেল ইউনিফর্ম পরিহিত একজন মানুষ। তার হাতে একটা সমন। সেটা পড়ে শোনাতে লাগলো সে। স্লীম্যানএখনো তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে, সেই অদ্ভুত কৃষ্ণ গহŸরের দিকে। সমন পরা শেষ হতেই মুখোশ পরা একজন মানুষ এগিয়ে গিয়ে মঞ্চের ওপরে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের মুখে কালো আবরণ পরিয়ে দিলো। অপরজনের দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা ডুকড়ে কেঁদে উঠলো। কিন্তু কৃষ্ণ গহŸরের ভেতরে কোন দ্বিধা নেই, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ¯øীম্যানের দিকে, ¯øীম্যানও তার দিকে। শুধুমাত্র একটা হাত তুলে মুখোশ পরতে অস্বীকৃতি জানালো সে, মুখোশ পরানো হলো না তাকে, কিন্তু অন্য জিনিসটা পরানো হলো ঠিকই। স্লীম্যানভেবেছিলো লোকটার দৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন আসবে, কিন্তু তাকে হতাশই হতে হলো।

কাজ শেষ হতেই স্লীম্যানআবারো একটা হাত তুললো। এবার আরো দ্বিগুণ বেগে বাজতে লাগলো বাদ্য। বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে বাদ্যের উচ্চনিনাদে কান ফেটে যাবার জোগাড়। ¯øীম্যানের হাতটা এখনো শুণ্যে। স্লীম্যানজানে সে হাতটা নামিয়ে নিতেই দুটো ঘটনা ঘটবে। আর এর ফল হবে একেবারেই অপার্থিব কিছু একটা। কিন্তু এই অপার্থিব ঘটনা ঘটানোর অধিকার কি তার আদৌ আছে, এর প্রয়োজনীয়তাই বা কতোটুকু। অন্য কোন উপায় কি ছিল না… স্লীম্যানহাত ওপরে রেখেই চট করে আবারো ফিরে তাকালো ম্যাকফির দিকে। একমাত্র ম্যাকফিই অনুধাবন করতে পারে তার দ্বিধা আর ব্যাকুলতা। ম্যাকফি তার দিকে তাকিয়ে আবারো সেই আশ^াসের ইশারা করলো। ওরা যা করতে যাচ্ছে সেটা ঠিকই আছে। এটাই সঠিক পথ, এটাই সবোত্তম পন্থা, কিন্তু তবুও মানুষ হিসেবে মানুষের প্রাণ নেয়াটা কখনোই সহজ ব্যাপার নয়…

স্লীম্যানচট করে হাতটা নামিয়ে নিলো, প্রায় সাথে সাথেই থেমে গেল বাদ্যযন্ত্রের নিনাদ। মুহূর্তের জন্যে নিঃশব্দের হাহাকার যেন ঝুলে রইলো বাতাসে, তীব্র বাজ পড়ার শব্দের সাথে সাথে মহাবীর সিঙের কুঠারটা হাত থেকে ছুটে গিয়ে মাটিতে গেঁথে গেল। আরা মঞ্চের ওপরে মুখোশ পরা জল্লাদ ঠেলে নামিয়ে দিলো একটা পাটাতন। মুহূর্তের ভেতরে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়লো মঞ্চে উপবিষ্ট চার কুখ্যাত ঠগী, বহু চেষ্টাতেও যাদের ভেতর থেকে নির্মূল করা যায় নি ঠগীত্বেও বীজ। দেহগুলো কিছুক্ষণ দড়িতে ঝুলে তড়পালো, তারপর শান্ত হয়ে গেল।

মৃত্যুর সাথে সাথে বিষন্ন এক নিস্তব্ধ নীবরতা নেমে এলো চারপাশে। বাতাসে বৃষ্টির শব্দ। কিন্তু স্লীম্যানের মনের ভেতরে তীব্র ঝড়। তারণ মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তেও সে তাকিয়ে ছিলো ঠগীদলের নেতা, মঞ্চের মাঝের সেই লোকটার কৃষ্ণ গহŸরের মতো দৃষ্টির দিকে। ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে লোকটা বিড় বিড় করে বলে উঠেছিল একটা কথা।

স্লীম্যানস্থানুর মতো বসে আছে ঘোড়ার ওপরে। পাশেই আরেকটা ঘোড়ার খুড়ের শব্দ টের পেয়ে চোখ তুলে তাকালো সে। ম্যাকফি এগিয়ে এসেছে তার দিকে। “লোকটা কি মৃত্যুর আগে বিড় বিড় করে কিছু বলে গেল?” চট করে চোখ তুলে তাকালো স্লীম্যান। কিছু শুনতে না পেলেও ম্যাকফিও তাহলে লোকটার ঠোঁট নাড়ানো টের পেয়েছে। “আমি কি ভুল…

“তুমি ভুল দেখনি ক্যাপ্টেন, স্লীম্যান ঘোড়ার মুখটাকে অন্যদিকে ফেরাতে ফেরতে বলে উঠলো। “লোকটা মৃত্যুর আগে ঠিক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে ঠগীদের ভাষা রামসীতে একটা কথা বলে গেছে,” ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে ফেললেও স্লীম্যাননিজে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বাকিদের। ম্যাকফি, মহাবীর সিং, ডুম্বুর এমনকি নিরাসক্ত জোনাথনও কৌতুহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্লীম্যানের দিকে। সবাই জানতে আগ্রহী কী বলেছে লোকটা। কিন্তু কেউ কোন প্রশ্ন করলো না, স্লীম্যাননিজ থেকে বলে উঠলো, “লোকটা মরার আগে বলে গেছে, আমি আবার ফিরে আসবো’, কথাটা বলে স্লীম্যান একবার মঞ্চের কড়িকাঠ থেকে ঝুলন্ত লোকটার মৃতদেহটা দেখে নিয়ে আর অপেক্ষা করলো না, ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা দিলো দূর্গের দিকে।

 

প্রায় দেড় দশক পর

কথাটা কানে যেতেই হেনরী স্লীম্যানের কানটা আপনাতেই খাড়া হয়ে গেল। তার পাশে বসা মানুষটা কিছু একটা বলছিলো তাকে নৃতত্ব নিয়ে, যেটা স্লীম্যানের বর্তমান গবেষণার বিষয়, আর তাই কথাগুলো বেশ মনোযোগের সাথেই শুনছিলো স্লীম্যানকিন্তু টেবিলের অন্য প্রান্তে বসা মানুষটার উদ্রিত বাক্যটার ক্রিয়দাংশ কানে আসতেই আপনাতেই ভ্রæ-জোড়া কুঁচকে উঠলো স্লীম্যানের। ভারতবর্ষে নিজের কর্ম জীবনের সাতচল্লিশটা বছর পার করা বৃদ্ধ স্লীম্যানআগের মতো দেখতেও পায় না, কিংবা শুনতেও পায় না। শাণিত ঈগলের মতো দৃষ্টি ধূসরিত হয়ে এসেছে বয়স আর ক্লান্তির কুয়াশায়, বলতে গেলে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে একটা হাত, সেই সাথে দূর্বল হয়ে এসেছে শ্রবণ শক্তিও। যদি আগের মতোই শাক্তিশালী কোনকিছু বিরাজমান থেকে থাকে, তবে সেটা হলো তার ক্ষরধার মস্তিষ্ক এবং ভারতমাতৃকার জন্য তার নিখাদ ভালবাসা। গত অর্ধশতকের কর্ম জীবনে যেটা শুধুমাত্র বৃদ্ধিই পেয়েছে। আজো ভারতবর্ষ আর এখানকার মানুষকে সে নিজের প্রথম প্রেমের ষোড়শী প্রেমিকাকে মানুষ যেভাবে ভালবাসে সেভাবেই ভালবাসে। আর তাই ভারতবর্ষ নিয়ে নেতিবাচক কিছু শুনলে ঠিকই কর্ণকুহরে প্রবেশ করামাত্রই সচেতন হয়ে ওঠে সে। স্লীম্যানকে ভ্রæ কুঁচকাতে দেখে তার সামনে উপবিষ্ট ইতিহাসের শিক্ষক ভদ্রলোক খানিকটা অবাক হয়ে গেছিলেন। এবার তাকে টেবিলের ওপর প্রান্তের দিকে ফিরে তাকাতে দেখে ভদ্রলোক একেবারে থেমেই গেল। 

সময়টা বিকেল বেলা। স্লীম্যানপরিকবারের বাসভবনের সামনের লনে বৈকালিক চা পানের আড্ডা চলছে। এই আড্ডাটা নিয়মিত হলেও আজকের আড্ডাটা বিশেষ, কারণ এক অর্থে বলতে গেলে এটা স্লীম্যানের বিদায় আড্ডা। ভারতবর্ষে নিজের দীর্ঘদিনের কর্মজীবন শেষ করে স্লীম্যানআর কয়েকদিনের ভেতরে স্বস্ত্রীক ফিরে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। আর সে-উপলক্ষ্যেই আজকের বৈকালিক আড্ডায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বেশ কিছু পারিবারিক অতিথী, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীকে। আয়োচজনটা হুট করে করাতে অনেকেই আসতে পারেনি তবে যারা এসেছে তাদেরকে নিয়েই জমে উঠেছে বৈকালিক আড্ডা। চা পানের পর চলবে সংগীত পরিবেশনা এবং সবশেষে রাতের আহার। আর সেই চা পানের আসরেই একজনের কথা শুনে কান খাড়া হয়ে গেছে স্লীম্যানের। তার সামনে উপবিষ্ট শিক্ষক ভদ্রলোক থেমে যেতেই স্পষ্ট শুনতে পেল স্লীম্যান। তাদের টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা তরুণ অফিসার ভারতবর্ষের এবং এখানকার মানুষের নামে বদনাম করছে। কথাগুলো শুনতে শুনতে আনমনেই একবার মাথা নাড়লো স্লীম্যান। সেই সাথে তার মনে পড়ে গেল এই ভারতবর্ষে পদাপর্ণের সময়টা।

মিলিটারি পরিবারে জন্ম নেয়া স্লীম্যানভারতবর্ষে পাড়ি দিয়েছিল দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এবং যতোটা স্বপ্ন নিয়ে সে পৃথিবীর এ-প্রান্তে এসেছিল তারচেয়ে অনেক বেশি সফল ছিল তার ভারতযাত্রা। তরুণ যেসব অফিসার ভারতের মাটিতে দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পা রাখে তাদের অনেকেই হয়তো সফল ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে সমর্থ হয়, কিন্তু খুব অল্পই ভারতবর্ষের মাটির গভীরে গিয়ে সত্যিকার অর্থে ভারতবর্ষকে ভালবাসতে পারে, আক্ষরিক অর্থেই ভাল কিছু করতে পারে এই মাটির মানুষের জন্যে। স্লীম্যানের ইচ্ছে ছিল, সুযোগ এসেছিলো, পহাড়সম প্রতিজ্ঞা ছিল, আর তাই সে তার এই দীর্ঘ কর্মজীবনে সে ভারতবর্ষের মাটি থেকে মিটিয়ে দিতে পেরেছিল সবচেয়ে বাজে কালীমার দাগটা। যাদের নাম ছিল ঠগী।

ঠগী এমন এক কলঙ্কের নাম যাদের হাত ধরে খুন হয়ে যেত হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। শুধু খুন নয়, ভারতবর্ষের পথ-প্রান্তর থেকে হাজারো মানুষ গায়েব হয়ে গেছে এদের দেবী আরাধনার নামে। স্লীম্যানযখন এদের ব্যাপারে খোঁজ শুরু করে তখন ইংরেজ তো বটেই এমনকি অনেক স্থানীয় মানুষেরও কোন ধারণা ছিল না এদের ব্যাপারে। কিন্তু স্লীম্যানঠিকই খুঁজে বের করেছিলেন এদেরকে অন্ধকারের অতল থেকে। শুধু খুঁজেই বার করেননি, সমূলে উৎখাত করে ধ্বংসও করেছিলেন এদেরকে। অযোধ্যা থেকে শুরু করে ইলোরা, মধুপুর থেকে শুরু করে মধ্য প্রদেশ এমন কোন স্থান নেই যেখান থেকে সে আর তার দল উপড়ে তুলে ফেলে দিতে সক্ষম হয়নি এই ভয়ঙ্কর খুনে দলের শিকর।

তবে স্লীম্যানের প্রকৃতকর্ম তৎপড়তা এমনকি এখানেও নয়। এই ভয়ঙ্কর খুনে দলকে খুঁজে বের করে সেইসাথে ধ্বংস করে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের রাজ দরবার পর্যন্ত সচকিত করে তোলার ক্রেডিট যদি তাকে দিতে হয় তবে তারচেয়ে বেশি দিতে হয় দলকে দল ঠগীদের স্বভাব পরিবর্তন এবং পরিবার সহ তাদের পূনর্বাসন করতে পারার সফলতাকে। ¯øীম্যানের মতো বুদ্ধিমান মানুষের জন্যে এটা অনুধাবন করা খুব বেশি কঠিন ব্যাপার ছিলো না যে বৃটিশ রাজ আর সরকারি দপ্তর যতোই কঠিন হোক না কেন শুধুমাত্র খুন যখম সরাসরি যুদ্ধ আর ফাঁসী দিয়ে এরকম ভয়ঙ্কর খুনে দলের পূর্ণ বিনাশ সাধন করা যাবে না। ঠগী নামের অভিশাপ থেকে ভারবর্ষের মাটিকে মুক্ত করতে হলে একদিকে যেমন বহুমুখী দানবের মাথাগুলো কাটতে হবে, অন্যদিকে বন্ধ করতে হবে ক্ষতমুখগুলো। যাতে সেখান থেকে নতুন মাথা গজাতে না পারে। যে-কারণে একদিকে দলে দলে ঠগী ধরা চলতে থাকে, অন্যদিকে চলতে থাকে পূর্নবাসন। যারা ঠগী হিসেবে ধরা পড়ার পরও সুস্থ জীবন বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চাইবে তাদের জন্যে বৃটিশ রাজকে বহু অনুরোধ করে সে চালু করেছে পূনর্বাসন ক্রেন্দ্র, তাদেরকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রতিষ্ঠা করা এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিকল্পনাকারী ছিলো ক্যাপ্টেন চার্লস ব্রাউন। আর সার্বিক তত্বাবধানে ছিলো স্লীম্যাননিজে। একদিকে চলেছে কঠোর হস্তে ঠগী নিধন, অন্যদিকে চলেছে পূনর্বাসন কেন্দ্রে ঠগী থেকে শুরু করে তাদের পরিবার তাদের পরিজন থেকে শুরু করে সবার নতুন জীবন এবং কাজ শুরু করার দীক্ষা।

যে-মানুষটা আগে নিখূঁত হাতে মানুষের গলায় ফাঁস পরাতো সেই মানুষটাই নিপুণভাবে তাঁত বুনছে, করিগরের কাজ শিখছে। তার ছেলেমেয়েরা সাহায্য করছে, স্ত্রীরা শিখছে সেলাইয়ের কাজ। স্লীম্যানের কঠোর নির্দেশনা ছিলো যেসব ঠগী রাজ স্বাক্ষী হয়ে নিজেদের জীবন বদলে নতুনভাবে সব শুরু করতে চাইবে তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে এখানে থেকে কাজ শিখে পুরোপুরি বিশুদ্ধ হয়ে বেরুতে হবে। স্লীম্যানের ইচ্ছে একটাই, ভারতবর্ষের বুকে ভবিষ্যতে যাতে কেউ আর কোনদিন না বলে আমি ঠগীর ছেলে ঠগীর সন্তান। সত্যি কথা হলো স্লীম্যানের পরিকল্পনা কঠিন হলেও পুরোপুরি কাজে দিয়েছে। পথটা কঠিন ছিল, এতো সহজে এক দল খুনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সহজ ছিল না। তবে প্রায় বিশ বছরের ব্যবধানে স্লীম্যানতা করতে সক্ষম হয়েছিলো। সে বদলে দিয়েছিলো অসংখ্য পরিবার, হাজারো জীবন। বিনিময়ে সে পেয়েছে নিজেচর ক্যারিয়ারে সফলতা, পেয়েছে অসংখ্য মানুষের সীমাহীন ভালবাসা। আর সে-ভালবাসা এতেটাই গভীর যে তার নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটা পুরো গ্রাম, যার নাম স্লীমেনাবাদ। ভারতবর্ষ থেকে রোসন জমাদার, রুস্তম খা, এনায়েত দুর্গা, কল্যাণ সিং, ফিরিঙ্গীয়ার মতো খুনিরা বিদেয় নিয়েছে, প্রজ্জ্বলিত রয়েছে স্লীমেনাবাদ নামের গ্রামে এক সময়ে ফিরিঙ্গী ‘ঠগী স্লীম্যানে’র নামে জ¦লন্ত শিখা।

স্লীম্যাননিজেও এখন বদলে গেছে অনেক, বিয়ে করেছে বহু বছর আগে। রয়েছে একাধিক সন্তান, তারাও যার যার পথ বেছে নিয়েছে এখন। স্লীম্যাননিজে ১৮৩৮ সালে সুপারিনটেনডেন্ট জেনারেলের পথ থেকে সরে গিয়ে কমিশনার হেয়ছিলো বটে তবে এর দশ বছর পরে আবার সরে এসেছে সেই পথ থেকে। কারণ ভারতবর্ষে আর ঠগী নেই। বরং সেই পদে নিজের ভাইপো কর্ণেল জেমস স্লীম্যানকে বসিয়ে এখন তিনি লক্ষেèৗর অধিবাসী। এখানে বসেই শেষ বয়সে সে নৃতত্ব নিয়ে গবেষণা করছে এখন। প্রমাণ করতে চায় কেন্টের নাইট আর পাঞ্জাবের দলিতেরা একই নৃতাত্বিক উৎস থেকে আগত, প্রমাণ করতে চায় ভারতের জাঠ আর ইল্যান্ডের জাটদের ভেতরের সংযোগ। এটাই এখন তার নেশা, আর সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তরুন অফিসারের ভারতবর্ষ নিয়ে অভিযোগ শুনে ফিরে তাকালো স্লীম্যান।

তরুণ অফিসার হাত নেড়ে নেড়ে খুব হাসিমুখে ভারতবর্ষ নিয়ে কটু কথা বলছিলো। স্লীম্যানকে ফিরে তাকাতে দেখে, থেমে গেল সে। টেবিলের সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। “ইয়াং ম্যান, কতোদিন হলো তুমি ভারতবর্ষে এসেছো?” স্লীম্যানযেন খানিকটা হাস্য মুখেই কিন্তু ভারি গলায় জানতে চাইলো। টেবিলের আলোচনায় যে-কিছু একটা গড়বড় হয়েছ এটা সবাই বেশ পরিষ্কার অনুধাবন করতে পেরেছে। কারণ স্লীম্যানের ভারতপ্রীতির কথা কারো অজানা নয়। “বলো ইয়াংম্যান, কতোদিন হলো তুমি ভারতে এসেছো?”

“স্যার, এক বছরের ওপরে,” তরুণ অফিসারের গলায় এখনো উদ্ধত ভাব থাকলেও সে বুঝতে পেরেছে কিছু একটা ঠিক নেই। “আমি…”

স্লীম্যানএকটু কটুভাবেই একটা হাত তুলে থামিয়ে দিলো, “আমি আজ সাতচল্লিশ বছর ধরে ভারতবর্ষে কাজ করছি। আমার কি মনে হয় জানো, এখনো আমি ভারবর্ষ আর এখানকার মানুষের শেকড়ের গভীরে পৌছাতে পারিনি। আমি তুমি এক বছর ধরে কাজ করেই ভারতবর্ষকে বুঝে গেছো,” বলে স্লীম্যানটেবিলের অন্যদের দিকে দেখলো। “ইয়াংম্যান, আগে পায়ের নিচের মাটিকে বোঝার চেষ্টা করো। তারপর তার ওপরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো, তারপর সেই মাটি কেমন সেটা নিয়ে কথা বলো।”

শুধু স্লীম্যাননয় টেবিলেল সবাই চুপ। ফলে বেশ অদ্ভুত এক নিরবতা বিরাজমান হয়েছে টেবিলের চারপাশে, সেই তরুন অফিসারের মুখের হাসি মুছে গেছে।। স্লীম্যানমুহূর্তের জন্যে নিজেকে অপরাধি অনুভব করলো,  সে মনে হয় খানিকটা বেশি রুক্ষ হয়ে গেছে। টেবিলের ওপর থেকে নিজের চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো। “আমাদের তরুণ অফিসারের জন্যে। আমি তার সফলতা কামনা করছি,” বলে ইশারায় সবাইকে আবারো চা পরিবেশন করার জন্যে বরলো। সবাই স্বস্তির নিঃশ^াস ছাড়লো।

“এক্সকিউজ মি, আমি খানিক সময়ের জন্যে বিদেয় নিবো,” বলে নিজের ছড়িতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কণ্যা এলিজাবেথের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো, “মামণি তুমি কি বুড়ো বাপকে সঙ্গ দেবে? ঘরের ভেতরে আমার সামান্য কাজ আছে।”

এলিজাবেথ হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বাপরে একটা হাত ধরতেই দুজনে এগোতে লাগলো। বিকেলের আলোর রেখা কমতে কমতে প্রায় সন্ধ্যের রেশ নেমে এসেছে। আধারের কালীমা দিগন্তরেখা ছুঁয়ে নেমে এসেছে ঘরের কোনে। বিকেলের শেষ আলোয় সেদিকে এগোতে এগোতে ¯øীম্যানের কণ্যা এলিজাবেথ বাপের হাত ধরে সেদিকে এগোতে এগোতে জানতে চাইলো, “বাবা, তুমি ভারতবর্ষ নিয়ে কটু কথা বললেই এতো রেগে ওঠো কেন?”

“শোন মা, হাঁটতে হাঁটতে নিজের মেয়ের মাথায় একটা রেখে সে বলে উঠলো, “ভারতবর্ষ হলো আমার মায়ের মতো, আমার জীবনে যা কিছু অর্জন সবই পেয়েছি এই মায়ের কাছ থেকে, তাই এই মাকে কটু কথা বললে সহ্য করি কী করে? বলে আফসোসের সাথে সামান্য মাথা নাড়লো সে। “আর তাছাড়া এই তরুণ অফিসারেররা না বুঝেই…

“এই কারণেই কি তুমি উঠে এলে টেবিল থেকে? এলিজাবেথ মৃদু হেসে জানতে চাইলো। “সত্যি কথা বলো তো তোমার কাজ কি ঘরে?

“হা-হা,” বলতে গেলে প্রায় জোরে হেসে উঠলো স্লীম্যান। “হাজার হলেও সে আমাদের অতিথী,” বারান্দা পার করে ভেতরের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে উঠলো স্লীম্যান। “আর তাছাড়া কে বলেছে আমার কাজ নেই,” বসার ঘরটা পার হয়ে ভেতরের দিকে এগোচ্ছে তারা। একেবারেই সন্ধ্যের সময় হওয়াতে কাজের লোকেরা কেউই নেই ঘরে। নিশ্চই তারা সান্ধ্যকালীন কাজে ব্যস্ত। “আসলে আমি…মেয়েকে পাশে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো স্লীম্যানহঠাৎ থেমে গেল সে। চারপাশে নজর বোলাচ্ছে।

কিছু একটা ঠিক নেই।

মেয়ের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বাতির দড়ির দিকে হাত বাড়াবে তার আগেই তার দৃষ্টি চলে গেল পেছনের দরজার কব্জার দিকে। বহু বছরের যুদ্ধের ময়দানের অভিজ্ঞতা আর অপরাধিদের নিয়ে কাজ করতে করতে তার মগজের একটা অংশ আপনাতেই অনেককিছু বুঝতে পারে। বিশেষ করে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে।

“বাবা…” এলিজাবেথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলা তার আগেই স্লীম্যানমুখে একটা আঙ্গুল তুলে তাকে চুপ থাকতে বললো, সেইসাতে চট করে দেখে নিলো পেছনের দরজাটা। সেটা থেকে বেশ অনেকটাই এগিয়ে এসেছে তারা। কাজেই চাইলেই সে চট করে পিছনে ফিরতে পারবে না, সেইসাথে এলিজাবেথ তো রয়েছেই। মুহূর্তের জন্যে বিপদটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পারলেও এলিজাবেথের জন্যে কেন জানি তার মনটা হাহাকার করে উঠলো, সেইসাথে অনুধাবন করতে পারলো বিপদটা আসলে কোথায়।

এক মুহূর্তের জণ্যে দম নিয়ে নিজেকে শক্ত করলো সে, পেছন ফেরার উপায় যেহেতু নেই, কাজেই যদিও বৃদ্ধ হয়েছে তবুও ভারি শরীর নিয়ে বলতে গেলে দ্রæতই সে এগিয়ে গেল কামারার একপাশের জানালার মোটা পর্দাটার দিকে, তারপর সবল হাতটা দিয়ে একটানে ঝট করে সরিয়ে দিলো সে ওটা। বহুবছরের পোড়খাওয়া মস্তিষ্ক তাকে ধোঁকা দিলো না, পর্দাটার ওপাশেই ওৎ পেতে রয়েছে মুখোশধারী এক লোক, সন্ধ্যের বাতিহীন অন্ধকারে উদ্যত ততোধিক অন্ধকার এক ছায়া, ছায়াটার এক হাতে উদ্যত ছোরা।

এলিজাবেথ চমকে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার অগেই স্লীম্যানের রুক্ষ ধমক খেয়ে থেমে গেল। “কে তুমি? মৃদু হলেও প্রায় গর্জন করে জানতে চাইলো স্লীম্যান। এলিজাবেথ থেমে গেলেও আততায়ীর ভেতরে কোন বিকার নেই, সে অধো অন্ধকারের ভেতরেই দু-পা এগিয়ে এলো তাদের দুজনার দিকে। অন্ধকার হলেও  ছোরা হাতের আততায়ীর চোখের দৃষ্টিটা পরিষ্কার দেখতে পেল স্লীম্যান। “কে তুমি? আবারো গর্জন করে উঠে জানতে চাইলো সে। ভেতরে ভেতরে মৃদু আশা হয়তো কেউ তার গলা শুনে দেখতে আসবে।

“অতীতের ছায়া, বলে লোকটা আরো এক পা এগিয়ে এলো তাদের দুজনার দিকে। একহাতে এলিজাবেথকে আড়াল করে খানিকটা পিছিয়ে গেল স্লীম্যান। খুনী আবারো কথা বলে উঠলো, “আমি ভেবেছিলাম তুমি তো মরবেই কিন্তু তোমার জন্যে নিরীহ আরেকটি প্রাণ সংহার করতে হবে ভাবিনি,” স্লীম্যানখুব আশ্চর্য হয়ে কয়েকটা ব্যাপার অুনধাবন করলো একসাথে। যে-মানুষটা কথা বলে উঠেছে তার গলায় সিন্ধী টান, সাথে সাথে সে চোখ তুলে তাকালো লোকটার চোখের দিকে এবং অনুধাবন করতে পারলো আসলে কী হচ্ছে এখানে। এর আগের দুই দুইবার তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তুবে দুটোই রাজনৈতিক কারণে কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। এই লোক রাজনৈতিক খুনী না।

বিষয় হলো স্লীম্যানবুঝতে পেরেছে এ আসলে ঠগী। কারণ ঠিক এভাবেই কথা বলতো আরেক ঠগী, যাকে বারবার চেস্টা করেও সে শোদরাতে না পেওে অবশেষে ফাঁসি দিয়েছিলো। তবে গলার স্বরের চেয়েও বড় কথা লোকটার চোখ, সেই একই দৃষ্টি একই ভাষা, এই-চোখ ভোলার নয়। সত্যিই মৃত্যুর ওপার হতে উঠে এসেছে যেন সেই পুরনো প্রেতাত্মা।

“তুমি ঠগী?” এবার হিন্দিী, পাঞ্জাবি, উর্দূ বা ইংরেজিতে নয় বরং বহু বছর আগে জ্ঞানার্জিত প্রায় ভুলতে বসা ঠগীদের রামসি ভাষায় ধমকে উঠলো স্লীম্যান। উদ্যত খুনী মুহূর্তের জন্যে দ্বিধান্বিত হয়ে উঠলো, সাথে যেন খানিকটা চঞ্চলও। “তুমি আমাদের ভাষা জানো সিলিম্যান? লোকটার গলায় যেন খানিকটা কৌতুহল। “আমি তো …

“আবশ্যই আমি তোমাদের ভাষা জানি এবং এও জানি তুমি কে, বলে স্লীম্যানভয়ে মুরগীর বাচ্চার মতো কাঁপতে থাকা এলিজাবেথকে ছেড়ে দিয়ে দুই পা এগিয়ে গেল খুনীর দিকে। জীবনে বহু ঝুঁকিপূর্ন কাজ করা স্লীম্যানজানে, নিজের ভঙ্গুর আর দূর্বল শরীর নিয়ে সে পেরে উঠবে না এর সাথে। না পারবে নিজে বাঁচতে না, সাথে মরতে হবে একমাত্র আদরের কণ্যাটাকেও। তারেচেয়ে…

“আমি জানি তুমি কে, বলে সে আরেকটা ধাপ এগিয়ে গেল খুনীর দিকে,” তার আর খুনীর ভেতরে দূরত্ব এক ফুটেরও কম। উদ্যত ছোরা প্রায় ছুই ছুই, স্লীম্যানচট করে খুনীর মুখের অবরণটা টেনে নামিয়ে দিলো, সেইসাথে উচ্চারণ করলো একটা নাম। “ধূমা!

স্লীম্যানতার মুখের আবরণে হাত দিতেই লোকটা ছুরিটাকে মাথার ওপরে তুলে ফেলেছিলো তার বুকে বসিয়ে দেয়ার জন্যে কিন্তু নামটা উচ্চারিত হতেই থেমে গেল লোকটা। আবারো আরেক পলক দ্বিধা এসে ভর করলো খুনীর চোখে…”

“আমি জানি তুমি ধূমার ছেলে, ধূমাকে ফাসিঁ দেয়ার দুদিন পরেই তার ছেলে পূর্নবানসন কেন্দ্র থেকে পালিয়েছিলো। তুমিই সেই ছেলে। সেই একই চোখ, একই কথা বলার ধরণ…

“তুমি আমার বাপকে মেরেছিলে…

স্লীম্যানশান্ত স্বরে মাথা নাড়লো। “আমি তোমার বাপকে মুক্তি দিয়েছিলাম… সেইসাথে তার দলের প্রায় পঞ্চজাশজন নারীপুরুষকেও, যারা ভিন্ন জীবন বেছে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু ধূমার কারণে পারছিলো না। সে আর তার তিন সঙ্গীর মৃত্যু একাধিক পরিবারের মুক্তিপণ ছিলা। আমি ছিলাম স্রেফ বাহানা… স্লীম্যান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটার মুখের দিকে। মত্ত জোয়ান হলেও মুখটা এক কিশোরের, চোখের দৃষ্টির পর্দাটা কঠিন হলেও তার আড়ালে কোমলতার রেশ এখনো হারিয়ে যায়নি।

“যদি তাই হয় ফিরিঙ্গী, তবে আমিও তোমার মৃত্যুর বাহানা মাত্র, আর তোমার মেয়ের মৃত্যুরও, বলে প্রায় গর্জন করে উঠলো সে, ছোরা ধরা হাতটা আবারো ওপরে উঠে গেছে। “কে দিয়েছে অধিকার তোমাকে, ফিরিঙ্গী? আমাদের মাটিতে এসে আমাদের মাটিতে থেকে আমাদের বিনাশ সাধন করার…? বলো ফিরিঙ্গী, মৃত্যুর আগে জবাব দাও?

স্লীম্যান কুল কুল করে ঘামছে কিন্তু সে চোখের দৃষ্টি সরালো না, “ভালবাসা আর দায়িত্ববোধ দিয়েছিলো আমাকে অধিকার। এই মাটির ওপর থেকে বিষাক্ত এক কীটকে নিধন করার জন্যে, এই মাটির প্রতি আমার ভালবাসাই যথেষ্ঠ ছিলো। সেজন্যে তুমি যদি আমাকে মারতে চাও মারো। এই বৃদ্ধের মুত্যতে তোমার তরুণ মন শান্ত হলে তাই সই। তবে আমার মেয়েকে ছেড়ে দোও।

“তোমাদের দুজনকেই মরতে হবে” খুনী আবারো এগিয়ে এলো দুজনার দিকে।

“ঠিক আছে,” স্লীম্যানআবারো দুইপা এগিয়ে গেল তার দিকে। “তুমি কি ঠগী?

খুনী কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো

“আসল ঠগী? স্লীম্যানআরো এগিয়ে গেল তা দিকে। “যদি তাই হয়, তবে তোমার হাতে ছোরা কেন? যদি প্রকৃত ঠগীই হয়ে থাকো তুমি তবে রক্তপাতের মতো পাপ তুমি করতে পারবে? যদি করো তবে তাই সই, আমার ও আমার কণ্যার প্রাণ আমি তোমার হাতে সঁপে দিলাম,” বলে স্লীম্যাননিসজের কম্পনরত দুই হাত তুলে ধরলো তার সামনে। “রক্তপাতে মৃত্যুতে তোমার মা ভবানী কতোটা খুশি হয় আমি জানতে চাই।”

খুনীর চোখে যেন আগুন জ¦লে উঠলো মুহূর্তের জন্যে। তারপর সেখানে দেখা দিলো দ্বিধা, তারপর হাতের ছুরিটাকে মাটিতে ছুঁড়ে দিয়ে প্রায় গর্জন করে এগিয়ে গেল সে স্লীম্যানের দিকে। নিজের দুই হাত আঁকশির মতো বাড়িয়ে দিয়ে ধরে ফেলতে চাইলো স্লীম্যানের গলাটা। ধরতে ধরতেও অসহায় ক্রোধ, যাতনা আর যন্ত্রণার এক চিৎকার বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। স্লীম্যানকে না ধরে বরং ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টো এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে পেছনের দরজা দিয়ে।

স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে মাটিতেই বসে পড়েলা স্লীম্যান। চিৎকার করতে করতে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে নিচ্ছিলো এলিজাবেথ, স্লীম্যান হাত তুলে তাকে থামালো। “অস্থির হতে হবে না, ও আর ফিরে আসবে না, বলে স্লীম্যানতাকিয়ে রইলো পেছনের খোলা দরজার সন্ধ্যের অন্ধকারের দিকে। “ও ছিলো ভারতবর্ষের শেষ ঠগী।”

 

[নোট: উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যানসেই বৃটিশ অফিসার যিনি ভারতবর্ষ থেকে ঠগী দমনের জন্যে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার বিচিত্র কর্মময় জীবনে একাধিকবার তাকে আততায়ীর মুখে পড়তে হয়েছে। তবে একেবারে শেষ বয়সে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ভারত ছাড়ার কয়েকদিন আগে তাকে হত্যা করতে বাড়িতে প্রবেশ করেছিল এক আততায়ী ঠগী। সেই খুনীর সাথে স্লীম্যানের মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতার সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা এই গল্প। ]

2 thoughts on “শেষ ঠগী”

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

bn_BDBN